ডায়েরির পাতা থেকে...
- শ্রী যুগল কিশোর গোস্বামী -
07.03.2023
" অনেক কথা যাও যে ব'লে কোনও কথা না বলি।
তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি।।"
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কাছে বই নেই। তাই quotationটা ঠিক হল কিনা বুঝতে পারছি না। ভোলানাথ সম্বন্ধে ভাবতে গেলে ঐ কথাগুলি মনে পড়ে।
এবারের ২৫শে ডিসেম্বরে (২৫/১২/২০২২) ভোলানাথ সম্বন্ধে কিছু বলতে হয়েছিল। বক্তৃতার শেষে ডাক্তার নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের (হাবুদার) পুত্র আমার কাছে এসে বললেন,"আপনি ভোলানাথ জ্যেঠার শিষ্য। আপনার কথাগুলো শুনে বুঝলাম ভোলাজ্যেঠাকে আপনারা কিভাবে পেয়েছিলেন এবং কিভাবে দেখেছিলেন। আমরা বাড়ির লোক। আমরা কিন্তু কিছুই বুঝিনি তাঁকে।"
যাই হ'ক বললাম, " আপনারা বাড়ির লোক। আপনাদের পক্ষে তাঁকে বোঝা প্রায় অসম্ভব।"
"ভোলাজ্যেঠার শিষ্য " শব্দগুলি শুনে একদিকে যেমন আত্মশ্লাঘা হলো, অন্যদিকে নিজেকে মনে মনে প্রশ্ন করলাম : আমি কি এতটা যোগ্যতার অধিকারী ?
উনি বলতেন,"শাস্ ধাতু থেকে শিষ্য শব্দটি এসেছে। শিষ্য সেই যাকে শাসন করা যায়।"
সে যাই হোক " ভোলাজ্যেঠার শিষ্য " শব্দটি আমার স্নায়ুতন্ত্রে সুখকর অনুরণন তুলল। এটা যে কত বড় মর্যাদা, কেউ না বুঝুক, আমি তো বুঝি।
বিশ্ব যেদিন ভোলানাথকে জানতে পারবে, তখন সবার মতন বাড়ির লোকও চমকে উঠবে।
এর কারণ কি? এই প্রশ্নটাই স্বাভাবিক।
এর অনেক কারণ আছে। সেইসব তাত্ত্বিক আলোচনায় যাচ্ছি না। একটি ঘটনা কেন্দ্রিক ব্যাখ্যা দেবো। তার আগে একটু তাত্ত্বিক কচ্ কচি এড়ানো যাচ্ছে না।
বলা হয়, গীতায় যা abstract, ভাগবতে তা concrete, গীতায় যা প্রস্তাবনা, ভাগবতে তা উপস্থাপনা। (preamble and concrete illustration)
ভোলানাথ-যাপিত জীবন (lived life) হলো 'naked eye'-এ তাঁর তত্ত্ব দর্শন এবং প্রয়োগ। ভাবদৃষ্টিতে দেখা নয়, নগ্ন-চোখে- দেখা সত্যের উপস্থাপনা।
ভোলানাথের কাছে যাওয়ার অনেক আগে থেকে জানতাম যে, যাঁরা বড় মাপের মানুষ, ভেতরের ঐশ্বর্যে যাঁরা সমৃদ্ধ, তাঁদের সাথে মেলামেশা করা, তাঁদের প্রাত্যহিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকলেই আমাদের stature টা বেড়ে যায়, ভেতরের height বেড়ে যায়, বাইরের থেকে সে পরিবর্তন নিজের চোখেও ধরা পড়তে পারে বা ধরা না ও পড়তে পারে। কিন্তু ভেতরের পরিবর্তনের যে প্রবাহমানতা, তা " ভুলে যাওয়া গানের মতো " রেশ রেখে যায়।
নচিকেতাকে যমরাজ বলেছিলেন, "মৃত্যুর পরে জীবন আছে কি নেই, তা জ্ঞানীরাই জানে না, সাধারণের কথা আর কি বলব?"
এখানে "জ্ঞানী" বলতে সেই বুধমন্ডলীকে বলা হয়, যারা খ্যাতির আকাশে শুকতারা। কিন্তু যে জ্ঞান জীবনাতীত, খালিচোখে-দেখা বিশ্বের বাইরে অন্য এক জগতের নিত্যস্থিতি, সেখানে তাদের, মানে তথাকথিত জ্ঞানীগুনী ব্যক্তিদের ভাবদৃষ্টি ও হয় না বা পৌঁছায় না। যৌগিক দৃষ্টি, নগ্ন-চোখে-প্রকাশিত সূক্ষ্ম জগৎ তাদের কল্পনাতীত।
একটা উদাহরণ দিই।
'ন হন্যতে' বলে মৈত্রেয়ী দেবীর বিখ্যাত বইটিতে তাঁর মনের অন্তহীন বিস্তারকে conclusion এ বলেছেন যে, সেটা সূক্ষ্ম শরীরের পক্ষ বিধূনন।
ভুল
সূক্ষ্ম শরীর সম্বন্ধে তাঁর প্রত্যক্ষ জ্ঞান কিছুই ছিল না। সেটা তাঁর বাকবিভূতি দিয়ে তিনি চাপা দিতে পারেন নি তো বটেই। বরং অজ্ঞতাকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। সাহিত্য হিসেবে যেটি অনির্বচনীয় হতে পারে, আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে সেটি ভ্রান্ত হতেই পারে। হয় ও। ব্যতিক্রম ও আছে।
এবার ভোলানাথের ভাষা এবং কথা নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করব। তাঁর ভাষা এমন সংসার কেন্দ্রিক, precisely down - to - earth, তাঁর প্রশ্নগুলি অনেক সময়ই এমনই গ্রাম্য বৈষয়িক বুড়োদের কাছাকাছি তাঁকে নিয়ে আসে, তাঁর কথাবার্তা কখনও কখনও এমন প্রায় নির্লজ্জ যে তাঁকে ভোলাজ্যেঠা বা স্কুলের সামান্য শিক্ষক বা কাঁচা বাজারে গিয়ে দরদাম করা এবং ঘুরে ঘুরে কম দামের আনাজ কেনায় পারদর্শী খদ্দেরের প্রতিমূর্ত্তি ছাড়া অন্য কিছু ভাবা প্রায় অসম্ভব।
তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের অল্প কয়েকদিনের মধ্যে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমার বাড়ির সকলের কথা, আমি কি চাকরি করি, কত টাকা মাইনে পাই, কতদূর লেখাপড়া করেছি প্রভৃতি। আমার বাড়ির সকলের খুঁটিনাটি তাঁর মুখস্থ।
তখনও বুঝিনি যে এ জন্ম শুধু নয়, আমার হাজার হাজার জন্ম তাঁর মুখস্থ।
আমি কাশ্যপ গোত্র, মানে আসলে চাটুজ্জে। চাটুজ্জেদের নিন্দাবিলাস তাঁর humour, এটি গভীর তাৎপর্যমন্ডিত।
একদিন বিশেষ অবস্থায় বলেছিলাম, " কাজটা কি ভাল করছেন?"
" কি, কি?" উনি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
বললাম , " চাটুজ্জেদের নিন্দা করা একদম ছেড়ে দিয়েছেন যে !"
অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসারিত হলো আলো
" চাটুজ্জেদের গালাগালটা eternal "
'গালাগাল' শব্দটি এখানে ব্যাজস্তুতি। আমার যা বোঝার বুঝে নিলাম।
সাক্ষাতের প্রথম দিকের কথায় আসি। ১৯৭২ সাল ।
সেদিন তাঁর পায়ের তলায় একটি ১০০ টাকার নোট কিছুটা দ্বিধার সঙ্গেঁ রেখে দিয়েছি।
প্রশ্রয়মিশ্রিত সতর্কীকরণের ভঙ্গীতে বললেন, " টাকা দিচ্ছেন বলে এত সঙ্কোচ কেন? সকলের সামনে দেখিয়ে দেখিয়ে দেবেন।"
যিনি এত reserved এবং নিঃস্পৃহ, যাঁর আধ্যাত্মিক জীবনের কথা পাড়াপড়শিরা কেউ জানত না, সহকর্মীদের কেউই বোধহয় না, আত্মীয় স্বজনরাও প্রায় সেই রকমই, যিনি চীৎকার করে ভগবানের নাম করা পছন্দ করেন না, দ্যাখনাই যাঁর একদম নেই, তাঁর মুখ থেকে এমন কথা অবশ্যই ভাবিয়ে তোলে। ভাবলেই অনেক কিছু খুলে যাবে।
আটের দশকের সূচনা পর্ব।
বিখ্যাত উকিল জি. সি. মুখার্জ্জির বাড়িতে উনি প্রথম দিন গেছেন। গাড়ি করে উনি নিয়ে গেছেন। এই গাড়িটার একটা ইতিহাস আছে। ওনার মেয়ের বিবাহ দিতে গিয়ে কিছুতেই উপযুক্ত পাত্র পাওয়া যাচ্ছিল না। জি. সি-র অনুরোধে ভোলানাথের শরণাপন্ন হলাম। ওনার মেয়ের ঠিকুজি-কুষ্ঠীর ছকটা দিলাম।
উনি প্রথম প্রশ্ন করলেন, " মেয়ের বাবার তো গাড়ি আছে। আমাকে গাড়ি করে ওনার বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন না ?"
উনি সহজে কারুর বাড়ি যান না। কত ভক্ত কতবার ওনাকে তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেছে। উনি কর্ণপাত করেন নি। এখানে যেচে বাড়ি যেতে চাইছেন। আমি একটু প্রমাদ গুনলাম।
অজিত বাবুর মধ্যস্থতায় জি. সি গাড়ি ক'রে তার বাড়িতে নিয়ে গেল।
গৃহদেবতা নারায়ণের ভোগ এবং প্রসাদ যেসব প্রাচীন যুগের পাথরের বাসনে অর্পিত হয়, সেই রকম বাসনে ভোলানাথকে খেতে দিলেন জি. সি. র পরিবার। ভোলানাথ প্রচুর সন্মান পেলেন।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে একান্তে অজিত বাবুকে বললেন, "G.C সব করেছে কিন্তু একটা ভুল করেছে। মাল ছাড়েনি।"
মানে টাকা দেয় নি। কত টাকা দিতে হবে বলে দিলেন (সামান্য একশত টাকা)।
" টাকা দেয়নি বলে 50% কাজ হয়েছে। টাকা দিলে বাকি 50% হয়ে যাবে।" স্পষ্ট বলে দিলেন।
G.C. সব জেনে গাড়ি ক'রে নির্দেশমতো হাওড়ার নেতাজি সুভাষ রোডে ' অরোরা বুক ডিপো '-র কাছে নির্দিষ্ট সময়ে অপেক্ষামান। ঠিক সময়ে ভোলানাথ উপস্থিত হলেন।
G.C. সাদা ধবধবে প্যান্ট-শার্ট পরিহিত অবস্থায় (উকিলের পোশাকে) হাঁটু গেড়ে প্রনাম করে হাতে টাকাটা নিয়ে দ্বিধা থরথর অবস্থায় হাঁটু গেড়ে বসেই রইলেন। কিছুতেই টাকাটা দিতে পারছেন না।
মাস্টারমশাই ধাক্কা দেওয়ার মতন কন্ঠস্বরে বললেন, " লজ্জা কিসের টাকা দিতে ? দিন।"
এই বলে টাকা হাত বাড়িয়ে নিলেন।
"ঐ নোংরা জিনিসটা (টাকা) কি ক'রে ওনাকে দিই ?" জি.সি. আমাকে তার দ্বিধার কথা ব্যক্ত করেছিল।
আমি বললাম, " আমাদের ভদ্রতাবোধ সমাজ জীবনে ভীষণ জরুরী। কিন্তু কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভদ্রতাবোধ ও ছাড়তে হয়। ভগবানকে একমাত্র আমরা সব বলতে পারি। যা কারুর সঙ্গে share করা যায় না, তা ভগবানের সঙ্গেই একমাত্র share করা যায়। ভোলানাথের কাছেই আমরা একমাত্র নির্লজ্জ হতে পারি। তাঁকেই একমাত্র সব কথা বলা যায়।"
ভোলানাথের সঙ্গে মিশলেই ভেতরের stature টা বড় হয়ে যায়। এই stature বৌদ্ধিক উচ্চতা (intellectual height) নয়, আত্মিক অবস্থার ক্রমবিকাশ।
সঙ্গে সঙ্গে বলি, " Bholanath is a tour - de - force in spiritual landscape." ভোলানাথ ব্যতিক্রমী মহাপুরুষ বা অন্য কিছু। stereotyped মহাপুরুষ নন। ছক ভাঙ্গার খেলা তাঁর দৈনন্দিন আচরণে, তাঁর প্রজ্ঞার বিতরণে।
সেদিন আমি উপস্থিত ভোলানাথের সামনে।
একজনকে বলছেন, " এখানে আসলেই হবে। কাছে বসলেই হবে। আর টাকাও দিতে হবে, সন্দেশ ও দিতে হবে।"
টাকা আর সন্দেশ ব্যাপারটা বিশেষ গবেষণার বিষয়। ঝট্ ক'রে মন্তব্য করা সোজা। তলিয়ে দেখা খুব শক্ত।
ওনার কাছে একদিন বসে আছি। ডান হাত টা নিজের হাঁটুর ওপর রেখেছি। আমার হাতের চেটোটা দেখা যাচ্ছে।
উনি আমার হাতটা দেখেই বললেন, "দেখি, দেখি হাতটা দেখি।"
হাতটা দেখেই বললেন, " আপনি এখন এখানে কেন ? আপনার তো এখন বিদেশে থাকার কথা। আর এতকম লেখাপড়াই বা আপনার কি ক'রে হ'ল ? কি জানি, কেন সব উল্টো-পাল্টা হয়ে গেছে।"
উনি যা বললেন আমি তৎক্ষণাৎ সবটাই বুঝতে পারলাম। ১৯৭২ সালের ১৪ই এপ্রিল ওনাকে স্থূল শরীরে না দেখেই ওনার এমন কৃপা পেয়েছিলাম যে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আমার সবকিছু বদলে গেল। অনতিকাল পরেই বুঝেছিলাম যে, অনেক দুর্ভোগ নিতে হবে। যোগ্যতা অনুযায়ী আমি কিছুই পাব না। সেগুলি উনি অলক্ষ্যে থেকেই ছাড়িয়ে নিয়েছেন। অনেক কিছুই ছাড়তে হয়েছে ওনার কাছে আসার আগেই। সেই ছাড়াগুলো ওনার কাছে আসার প্রস্তুতিমাত্র - prelude - এইটাই গুরুদক্ষিণা। ওনার কাছে আসার অনেক অনেক আগেই উনি তা নিয়েছেন।
ব্যাসদেবকে একদিন বললাম, " গুরুদক্ষিণা দিতেই হবে। তুমি জানতেও পারো, নাও জানতে পারো। ভোলানাথ গুরুদক্ষিণা তোমার কাছ থেকেও নিয়েছেন। গুরুকে তো সবচেয়ে ভাল জিনিসটা দিতে হয়। পাপটা তো ভাল জিনিস নয়। পূণ্যটা ভাল জিনিস। ঐটাই গুরুকে দিতে হয়। ব্রহ্মজ্ঞ গুরু সর্বাগ্রে পূণ্যটা যতটা পারেন কেটে দেন। এর ফলে জীবনে সুখভোগ বা ভোগসুখ কাটা যায় অনেকাংশে। পূণ্য বলে যে সব প্রাপ্তিযোগ তোমার ছিল, সেগুলো কাটা গেছে বেশ বড় অংশে। এটাকেই বলে দক্ষিণা।"
দক্ষিণা মানে টাকা নয়। পাপ পুণ্যের অতীত অবস্থায় সদ্-গুরু নিয়ে যান। স্থূলে টাকা নেওয়া, সন্দেশ নেওয়াও একটা মাধ্যম। ব্যপারটা inclusive, exclusive নয়। এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক রকম।
ডাক্তার স্বপন ব্যানার্জী আমাকে বলেছিলেন, " কেন ওনাকে টাকা দিচ্ছেন, সন্দেশ দিচ্ছেন? বিষ দিচ্ছেন, জানেন না?"
আমি বললাম, " জানি। তবু বিষ আমাদের দিতেও হবে, ওনাকে খেতেও হবে। উনি ঐ বিষটাকেই অমৃতে পরিণত করেন এবং সেই অমৃতটা দান করেন। অনেকেই তার ভাগ পায়।"
ওনার কাছে বসলেই ভেতরটা এতো বড়ো হয়ে যায়, তা বলে বোঝাবার নয়। ওনার কথা মন দিয়ে পড়লেই মনের মনে অর্থাৎ আত্মায় কাজ হয়। আর ওনার কথা বুঝলেই - আরে ! নামক একটা তরঙ্গ মৃদুমন্দ পবনের মতো ভেতর থেকে বাইরে বেরোয় এবং "পেয়েছি"-র বোধ হয়। আমি এই আবিস্কারের নাম দিয়েছি "আরে তরঙ্গ," "আশ্চর্যবৎ পশ্যতি কশ্চিদ্ এনম্ " (গী/২/২৯)। আশ্চর্যবৎ।
সুজল বলত, "ভোলানাথের কথা 'গুলি - সূতোর' মতো। ছোট্ট একটা কথার 'গুলি'। টানো -- সুতো বেরোতে থাকবে। যতদূর টানতে পারবে, সুতোটা ততটাই হবে।"
একদিন ভোলানাথ কে জিজ্ঞেস করলাম, "ওঁকারের পরে কি আছে?"
উনি casually উচ্চারণ করলেন, " ওঁকারের পরে কিছু আছে, আবার নেই।"
একটু থেমে সংযোজন করলেন, "ওঁকারের পরে যা আছে, কেউ বলে সেটা শিবের কাছে আছে, কেউ বলে কৃষ্ণের কাছে আছে।"
কথাটা যে কত.মারাত্মক, এক বৈদান্তিক সন্ন্যাসীর সঙ্গে কথোপকথনে বুঝলাম।
সন্ন্যাসীর নাম আমি জানি না। আমাদের দেশের বাড়ির সন্নিকট এক মুখার্জ্জি পরিবারে উনি কয়েক বছর অন্তর অন্তর আসতেন এবং স্বল্পকাল অবস্থান করতেন।
উনি যেদিন M.A. পরীক্ষায় সাংঘাতিক ভালো ফল করলেন, সম্ভবত ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হলেন, সেই দিনই বেনারস চলে গেলেন এবং সন্ন্যাসদীক্ষা নিয়ে নিলেন। বিরাট বড়লোক ভূস্বামীর জ্যেষ্ঠ পুত্র। ছোট ভাইকে সব সম্পত্তি দিয়ে দিয়ে গ্রামের শ্মশানের কাছে একটা বিরাট আগাছাপূর্ন জমিতে নিজেদের জমিদারিতেই ছোট্ট আশ্রম করে গৃহত্যাগ করলেন চিরকালের মতন। তাঁর ছোট্ট আশ্রমটি ছিল বর্ধমান জেলার পাঁচলা নামক গ্রামে বলে শুনেছি। তাঁর সেবার জন্য তাঁর ছোট ভাইকে কিছুই করতে দিলেন না।
নিরস্ত হয়ে ছোট ভাই বললেন, "তোমাকে আমার কাছ থেকে একটা কিছু নিতেই হবে। তুমি দার্জিলিং চা ভালবাসতে। ঐটি আমি তোমাকে পাঠাব। তুমি আশ্রমে বসে চা বানিয়ে খাবে। ঐটুকু অনুমতি দিতেই হবে।" উনি সেই মিনতি মেনে নিয়েছিলেন। স্বপাক রন্ধন করে খেতেন।
ওনাকে বললাম, " জগন্নাথের ভোগের হাঁড়ির মতন একটা হাঁড়ির উপর আর একটি ওঁকার। এইভাবে বহুদূর বিস্তৃত ওঁকার সমূহের হাঁড়ির মতন থরে থরে সাজানো ওঁকার প্রকাশ হচ্ছে। ওর পরে কি আছে ?"
উনি বললেন, " ওর পরেও ঐটাই আছে। ওটার শেষ খুঁজে পাওয়া যায় না।"
যে জিনিসটার শেষ খুঁজে পাওয়া যায় না, সেই সম্বন্ধে ভোলানাথ কত হাল্কা ভাবে উচ্চারণ করেছিলেন, "ওঁকারের পরে যা আছে, তা কৃষ্ণের কাছে আছে, শিবের কাছে আছে।
গীতার পুরুষোত্তম তত্ত্ব এত হাল্কাভাবে কি কেউ বলতে পেরেছে ? পুরুষোত্তম তত্ত্বের পরেও যা আছে, তারও ইঙ্গিত আছে ঐ ছোট্ট কথায়।
'গুলি - সূতো' --- যতটা টানতে পারবে ততটা বাড়বে।
ওঁকারকে বাচক বা প্রকাশক বলা হয়। ব্রহ্মকে কেউ প্রকাশ করতে পারে না। ব্রহ্ম স্বপ্রকাশ। ওঁকার ব্রহ্মের কাছে পৌঁছে দেয় এবং তারপর পালায়। তাই ওঁকারকে বাচক বলা হয়। ওঁকার-লীন অবস্থা বা ওঁকার-সমাধির কথা ভোলানাথের মুখেই শুনেছি।
বলেছিলেন, " শঙ্করাচার্য বেশীরভাগ সময় ওঁকার সমাধিতে থাকতেন।"
কি করে তিনি জানলেন যে শঙ্করাচার্য অধিকাংশ সময় ওঁকার সমাধিতে থাকতেন ? এই সব প্রশ্নের উত্তর জানি না। তবে উনি যখন কথাটি উচ্চারণ করেছেন তখন তার নিশ্চয়ই তাৎপর্য আছে।
ওনার ভাষা, এমন কি লৌকিক ভাষাও যে বোঝা কত দুরূহ, তা বোঝার জন্য একটি উদাহরণ দিচ্ছি।
১৯৭৯ সালে "ব্রহ্মতত্ত্ব আলোচনা প্রসঙ্গে মাস্টারমশাই" গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। তার আগে ছাপার অক্ষরে ভোলানাথ সম্পর্কে একটি কথাও প্রকাশিত হয় নি।
বইটি যখন যন্ত্রস্থ তখন press এ strike শুরু হ'ল। বহু বাধা-বিপত্তির মধ্যে বইটির আত্মপ্রকাশ যখন বিলম্বিত হচ্ছে, তখন একজন ভোলানাথকে বললেন, "যুগল কি জানে যে বই লিখেছে ?"
ভোলানাথ উত্তরে বলেছিলেন, "ও কিছু জানে না বলেই লিখতে পেরেছে।"
ভোলানাথ নিজের মুখে আমার কাছে এই বিবরণ দিয়েছেন।
কথাটির তাৎপর্য যখন অনুধাবন করি, তখন ভাবি, কি আশ্চর্য ! এতো বড় মানুষের সংস্পর্শে এসেও, নিজেকে ভাগ্যবান বলে বুঝতে পেরেও, উনি যে পরম আশ্রয় -- সেই বোধ পাকাপাকি হলো না। এখনও অন্বেষণ !
ভোলানাথের ওঁকার শুধু প্রকাশকই নয়, আবরকও। ওনার ওঁকার ওনাকে ঢেকে রেখেছে। আবার তা ওনাকে প্রকাশও করে।
ভোলানাথের ভাষাও প্রকাশক এবং আবরক -- দুই-ই। যে নিতে পারল, নিল। যে পারল না নিতে, সেও পেল অন্যভাবে। কিন্তু বোঝে নি। না বুঝলেও হবে। মন দিয়ে শুনলেই হবে। তবে না - বোঝার চেয়ে বোঝা অবশ্যই বেশী ভাল।
জৈমিনীর পূর্ব মীমাংসায় প্রথম শ্লোক "অথাতঃ ধর্ম জিজ্ঞাসা।"
ব্রহ্ম সূত্রের প্রথম শ্লোক "অথাতঃ ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা।"
"অথ" মানে "তারপর" then, আবার অতঃ মানে "এই কারনে।" ব্রহ্মজ্ঞান জন্য পদার্থ নয়। (not anything created, নিত্য) ধর্ম জিজ্ঞাসা শেষ হলে ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা শুরু হয়।
ভুল। এই ধারণা ভুল। ব্রহ্মজ্ঞান কর্মজনিত কিছু নয়। ব্রহ্মজিজ্ঞাসা কার কবে শুরু হয়েছে এবং কেন হয়েছে-- খেই পাওয়া যায় না।
ভোলানাথ একদিন বললেন, "মনে করুন, কোনও ব্রহ্মজ্ঞানী আপনার দিকে তাকালেন। সঙ্গে সঙ্গে উনি বুঝে নিলেন, আপনার বাবা কেমন, মা কেমন, আপনার হাজার হাজার জন্ম কেমন।"
যিনি এইভাবে কথা বলেন, তিনিই আবার বলেন, "জিভে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।"
ভোলানাথের humour বা রসিকতা অন্তহীন। কখনও কখনও মনে হত উনি laughing gas ছেড়ে দিয়েছেন। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যেত। এই হাসানোটাও একটা যোগক্রিয়া। ভেতরের ফুলগুলো হাসির চোটে ফুটে ওঠে।
ছেলেবেলায় একটা গান শুনেছিলাম, " গানের চোটে কলসী ফাটে চাঁপাতলার কলেতে।"
Humour is a formidable weapon in the armoury of Bholanath.
হাস্যরস ভোলানাথের তূণে একটা বিরাট আয়ুধ বা অস্ত্র।
সাতের দশকের শেষ দিক।
আমি আর মাস্টারমশাই হাওড়া সাবওয়ের নিচেয় নামব। দাঁড়িয়ে আছি আর বিশ্বনাথ বাবু (ওনার ভাই) সাবওয়ে দিয়ে উপরে এসেছেন। ভোলানাথের সঙ্গে তাঁর ভাইয়ের দেখা হলো।
সংক্ষেপে সাংসারিক দু- চারটি কথা সেরে আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে ভোলানাথ বিশ্বনাথ বাবুকে বললেন, " ইনি আমার শিষ্য। ইংরেজীতে M.A., first class first."
বিশ্বনাথ বাবু চলে যেতেই বললেন, বেশ একটু অহংকার প্রকাশ করেই, "লোকে ভোলানাথ বাবুকে যতটা বাজে লোক ভাবে, ততটা মোটেই নয়।"
বলা বাহুল্য, আমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট নই। উনি তা জানতেন। তবু উনি আমাকে যেখানেই পরিচয় করান, বলেন, "ইনি ইংরাজীতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট।"
ওনাকে থামাতে পারিনি।
আমার ঐ উপাধি সত্যি নয়। সত্যি না হলেও, ব্যপারটা মজার। মজাটা উপভোগ করতে বাধা কোথায়।
ভোলানাথের অনেক কথাতে অনেক মজা আছে। কাছ থেকে দেখেছি বলে মজাটাও অধিকাংশ সময়েই বুঝে উঠতে পারিনি। বাড়ির লোকে ত পারেই নি।
আমার আধ্যাত্মিক জীবনে তিনটি landmark ঘটনা --১৯৭২, ১৯৮০, ১৯৮৯ ।
তিনটি ই উনি ঘটিয়েছেন। তিনি কিন্তু সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু কিছু না বলেও ষোলো আনা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, উনি কি দিয়েছেন।
কোন কিছু না বলে, উনি যখন ষোলো আনা বুঝিয়ে দেন, তখন তাঁকে এক রকম মনে হয়।
অনেক কথা বলে যখন কিছুই ভেতরে ঢোকান না, তখন বিস্ময়ের বদলে থাকে প্রতীক্ষা।
আর একটা মজার ঘটনা মনে পড়ছে।
সাতের দশক
আমাকে আর অচিন্ত্যকে নিয়ে উনি অবধূতের ডেরায় গেছেন।
অবধূত ভোলানাথকে জিজ্ঞেস করলেন, "এ দুটোকে পাকড়েছ ?"
একটুও না ভেবে ভোলানাথের প্রত্যুত্তর, "একটা প্রেত আর একটা পেত্নী।"
বুঝতে পারলাম, কথাটা অবধূত খুব appreciate করেছেন।
কিছু ভাঙলেন না।
অনেক পরে বুঝেছি, প্রেত বা পেত্নীর দেহ থাকে না। মরে যাওয়া মানে দেহবোধহীন অবস্থা লাভ করা।উনি অবধূতকে সান্ধ্য ভাষায় বুঝিয়ে ছিলেন, যে সে নয়, দুটি মুক্ত আত্মাকে এখানে হাজির করেছি। কোনও গুরু কি তাঁর শিষ্যকে এতটা প্রশংসা করে ? এত বড় প্রশংসা যে ভাষায়, সেই ভাষার কি ছিরি ! মরি মরি !
This was more than a moment of levity. (সেটি শুধু তুচ্ছ হাস্য পরিহাসের মুহূর্ত নয়)। It was his way of appreciating the greats. A strange joke conceals his high seriousness and shields him from public view as well.
ভাষা শুধু প্রকাশ করে না, ভাষা গোপনও করে, concealed wiring এর মতন। আজকের যুগে আধ্যাত্মিক বীজগুলি প্রথমে আকাশতত্ত্বে ঘনীভূত হয়, পরে বৃষ্টির আকারে নেমে আসে। বহু লোকে তার ভাগ পায়। ক্ষেত্র প্রস্তুত হলেই ফসল ফলে। চাষী যেমন হা পিত্যেশ করে চেয়ে থাকে মেঘের দিকে, তেমনই ধর্মমেঘ।
আধ্যাত্মিক সাত্বিক গুণের বিকাশ এবং বিস্তার হবে আকাশতত্ত্বে রেখে দেওয়া ভোলানাথের বীজগুলির অবতরণে। সেজন্যে প্রতীক্ষাই একমাত্র সাধনা। অন্য কোনও সাধনার প্রয়োজন নেই।
ওঁ ভোলানাথায় পূর্ণ ব্রহ্ম নারায়ণায় নমঃ ।।
*** সর্বস্বত্ব শ্রতি গোস্বামী কর্তৃক সংরক্ষিত ***
4A Diamond Enclave , Block-C,
T 35, Rajarhat Main Road
Teghoria, Kolkata -700157
ভোলানাথ জ্ঞান, যোগ এবং ভক্তির এক সংমিশ্রণ বা ফেডারেশন ছিলেন। একজন মানুষ হিসেবে ভোলানাথ নিজের আপনাকে অনেকের কাছে উপলব্ধি করার জন্য দ্বৈত ভূমিকা পালন করতেন। বাহ্যিক প্রকাশে তিনি সম্পূর্ণতই অনন্য ভক্তি ছিলেন। এই ভোলানাথ জানতেন যে মানুষ প্রাথমিকভাবে ভক্তির পথের মাধ্যমে উচ্চতর জ্ঞানের দিকে পৌঁছাতে সক্ষম হবে; তাই এই পথই তাদের জন্য সবচেয়ে উপযোগী।
অন্তরে ভোলানাথ ছিলেন একজন আদর্শ বেদান্তবাদী, মহাজাগতিক চেতনায় পরিপূর্ণ জ্ঞানের মূর্ত প্রতিমূর্তি। তিনি পুরোপুরি সচেতন ছিলেন যে সাধারণ মানুষের সহজ প্রবেশাধিকার আছে ভক্তিতে, কিন্তু জ্ঞান তাদের নাগালের বাইরে। অতএব তিনি কালী ও শিবের নাম জপের ব্যবস্থা করেন, যা সবাইকে সমান সুযোগ দেয়।
যখন ভক্ত আধ্যাত্মিক অগ্রগতির পথে থাকে, তখন তিনি ধীরে ধীরে উচ্চতর জ্ঞানের জন্য সংবেদনশীল ও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেন, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আসে।
এখানেই স্বয়ংক্রিয় যোগের অবদান নিহিত। ভোলানাথের প্রকৃত কাজ মনের ও আত্মার অন্তর্গত গভীর recess এ তাঁর শব্দ তরঙ্গ—সর্বব্যাপী ওমের ফাংশনে নিহিত। ভোলানাথের ওম শারীরিক ও মানসিক স্তরে ব্যাপক পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে কার্যকরী।
হঠযোগ শারীরিক নিয়মিত অনুশীলনে গুরুত্ব দেয়, যা মানসিক নিয়মানুবর্তিতার দিকে সহায়ক। রাজযোগ মানসিক ও মানসিক নিয়মিত অনুশীলনকে তীক্ষ্ণ করে তোলে, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে শারীরিক নিয়মিত অনুশীলনে নিয়ে যায়।
কিন্তু ভোলানাথের স্বয়ংক্রিয় যোগ হঠযোগ ও রাজযোগের সংমিশ্রণ বা সমন্বয়, কারণ সব ধরনের যোগ মস্তিষ্ক ও শরীরে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কাজ করে। ওমকে কোনো যোগব্যাকরণ শেখার দরকার হয় না।
ওম অবতার ভোলানাথ পেছন থেকে কার্যকরী, এবং সব ধরনের যোগ রিয়ালাইজেশন, প্রকাশ প্রভৃতি সাধনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
এই স্বয়ংক্রিয় যোগ শ্বাস-প্রশ্বাস ও শরীরের ছন্দময় চলায় প্রভাব ফেলে, যাকে যোগ মুদ্রা বলা হয়। এর জন্য হঠযোগ বা রাজযোগের আনুষ্ঠানিক দীক্ষার দরকার হয় না।
কিন্তু এই স্বয়ংক্রিয় যোগ নিজের মধ্যে শেষ পর্যায় নয়। এটি সর্বোচ্চ সুখ ও জ্ঞানের পথ প্রশস্ত করে।
ওম-কেন্দ্রিক, ওম-পরিচালিত, ওম-প্ররোচিত পরিবর্তন ভক্তকে সর্বোচ্চ জ্ঞান ও সর্বোচ্চ ভক্তির প্রতি উদ্ধত করে। স্বয়ংক্রিয় যোগ একটি উৎসেচক হিসেবে কাজ করে। এর মাধ্যমে চেতনাতমক কণাগুলোর অবিরাম বর্ষণ ঐশ্বরিকতার সঙ্গে মিশ্রিত হওয়ার অবশ্যম্ভাবী প্রক্রিয়ার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে।
মহার্শি পাতঞ্জলির দ্বারা প্রচারিত রাজযোগ মনের নিয়ন্ত্রণের কঠোর সাধনার দাবি রাখে। ভগবদ্গীতার (অষ্টম অধ্যায়) রাজযোগে কোনো কঠোর আচরণবিধি বর্ণিত নেই এবং সেখানে বর্ণিত স্বয়ংক্রীয় যোগ পীড়াহীন পদ্ধতিতে অর্জিত হয়। এই স্বয়ংক্রীয় যোগের সাথে যে সহজতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা যুক্ত তা এই অভিব্যক্তিতে প্রতিফলিত হয়েছে:
"সুসুখং কার্তুম অব্যয়ং"
অতএব প্রকৃত যোগ হয়ত ক্লান্তিহীন শারীরিক, মানসিক বা বৌদ্ধিক ব্যায়ামের সঙ্গেও তেমন সম্পর্কযুক্ত নয়। স্বয়ংক্রীয় যোগ তখনই প্রকাশ পায় এবং নিজেকে প্রক্ষেপণ করে যখন ভোলানাথের ওম বা ভোলানাথের মূল শব্দ-তরঙ্গ ব্যক্তি বিশেষের মনস্তরের ওপর নামিয়ে আসে। তখন তিনি যোগ মুদ্রার মধ্য দিয়ে যেতে পারেন, যা হলো শারীরিক শক্তির বহিঃপ্রকাশ সহজ ও অনায়াসে শরীরের বিভিন্ন প্রকার আন্দোলনের মাধ্যমে। এই আন্দোলন ছন্দবদ্ধ হয় কারণ এটি ওম শব্দের আন্দোলন দ্বারা সৃষ্ট আধ্যাত্মিক প্রবাহের সাথে তাল মিলিয়ে চলে। আসলে ওম হল কার্যকরী শক্তি। এটি ওম শব্দের রোলিং এবং অনুরণন থেকে উদ্ভূত হওয়ায় শরীরের আন্দোলন ছন্দবদ্ধ হয়।
ওম হলো প্রাথমিক শব্দ-তরঙ্গ, যার সরাসরি এবং তাৎক্ষণিক প্রভাব এতটাই শক্তিশালী, প্রবল, অতিকায় এবং সর্বগ্রাহক যে মানুবদেহ তা সহ্য করতে পারে প্রায়ই না। শরীরের মধ্যে এটি ধরা বা ধারণ করা কঠিন, যতক্ষণ না শরীর যথাযথ পরিমার্জিত অবস্থায় পৌঁছে। এই শরীরের কাঠামো একটি স্বয়ংক্রীয় প্রক্রিয়ার অধীন হয় নাম জপের মাধ্যমে, যা শরীরকে ওম-এর বিকিরণ শোষণ করার উপযোগী করে তোলে। সাধারণত দীর্ঘ প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। কিন্তু ভোলানাথ এই প্রক্রিয়াটি সহজ করে দিয়েছেন। কোন অতিরিক্ত কষ্টসাধ্য প্রচেষ্টা প্রয়োজন হয় না। সবকোর জন্য উপযোগী করার জন্য, মূল শব্দ-তরঙ্গকে “বীজ-সাউন্ড ওয়েভ” বা “বীজ মন্ত্র” এ হ্রাস করা হয়েছে এবং আরও হ্রাস করে নাম- মন্ত্রে পরিণত করা হয়েছে, অর্থাৎ কালী ও শিবের নাম জপ। এটি ভোলানাথের চুম্বকীয় ওম-ব্যক্তিত্ব যে ভক্তকে অচেতন অবস্থায় গ্রাস করে এবং ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে নাম মন্ত্রের মাধ্যমে তাকে ওম-এর শিখরে নিয়ে যায়।
প্রত্যেকের জন্য এই নাম মন্ত্র (কালী ও শিব) সহজেই প্রবেশযোগ্য, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রীয়ভাবে ভিতরে ও বাইরে “বীজ মন্ত্র” এ রূপান্তর ঘটে (কোন ক্যো সচেতন প্রচেষ্টা ছাড়াই) এবং শেষ পর্যন্ত ভিতরে ও বাইরে এর প্রাকৃতিক মহিমায় ওম এ পরিণত হয়। এটি যেন কোনো স্থান থেকে একদম অপ্রত্যাশিত, অপ্রচলিত এবং অচেতনভাবে আত্মপ্রকাশ করে। এই আবিষ্কার একটি চালিকা শক্তি হয়ে কাজ করে এবং মাদকসুলভ আবেশে আপনি জীবন থেকে আর কিছু চাইতে চান না।
শব্দ-তরঙ্গের মুক্ত খেলায় এই রূপান্তর প্রক্রিয়া পরিশীলনের নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। আধ্যাত্মিকতাই পারদর্শিতার সর্বোচ্চ রূপ। এখন থেকে কংক্রিট (বস্তুগত) চাহিদা থেকে বিমূর্ত চাহিদার তৃপ্তির পথে যাত্রা একটি অবিরাম প্রক্রিয়া। একবার শুরু হলে এটি অন্তহীন চলে, আধ্যাত্মিক অগ্রগতির মাইলফলক সৃষ্টি করে।
যুগ যুগ ধরে অন্তরের সর্বোচ্চ আনন্দ আবিষ্কার মানবজাতিকে ব্যথা ও কষ্ট থেকে উদ্ধার করে শান্তি, ভালোবাসা ও অসীম আনন্দের দিশারি হিসাবে কাজ করছে।
এই স্বয়ংক্রীয় যোগে সবকিছু ইতিবাচক এবং কোনো কিছুই নেতিবাচক নয়।